ইতিহাসের মহানায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা এবং তার সংগ্রামী জীবনের গল্প

পৃথিবী যাদেরকে চিরকাল মনে রাখবে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। যার পুরো নাম নেলসন রোলিহলালা ম্যান্ডেলা (Nelson Rolihlahla Mandela)। তিনি দক্ষিণ অাফ্রিকার বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে বর্ণভিত্তিক গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার কারণে ২৭ বছর কারাভোগ করতে হয় এই কিংবদন্তিকে। ১৯৯৩ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে অালোচনা করবো অাজ।
Image result for mandela

জন্ম

নেলসন ম্যান্ডেলা ১৮ জুলাই ১৯১৮ সালে অাফ্রিকার মেম্বু রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দক্ষিণ অাফ্রিকায় ‘মাদিবা’ নামে পরিচিত। গোত্রের লোকজন তাকে মাদিবা নামে ডাকতো। ম্যান্ডেলার বাবার নাম গাডলা হেনরি। গাডলা ছিলেন মেম্বু সম্প্রদায়ের মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার মায়ের নাম নোসেকেনি ফ্যানি।

শিক্ষা  জীবন

ম্যান্ডেলার বয়স যখন ৭ বছর তখন তার মা তাকে নিয়ে কুনু নামক একটি গ্রামে অাসেন। কুনু গ্রামের মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন ম্যান্ডেলা। অষ্টম শ্রেণী পাস করার পর ফোর্ট বোফেট হেল্ডটাউন স্কুলে ভর্তি হন তিনি। স্কুল পাস করার পর ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব অার্টস কোর্স এ ভর্তি হন। ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এসে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অাফ্রিকান দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়াটার্সরান্ডে অাইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেন।

দাম্পত্য জীবন

ম্যান্ডেলা জীবনে তিনবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ইভিলিন নতোকো মাসে। ১৩ বছর সংসার করার পর ১৯৫৭ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ম্যান্ডেলার দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম উইনি মাদিকিজেলা ম্যান্ডেলা। তৃতীয় স্ত্রী হলেন গ্রাসা মাচেল। নেলসন ম্যান্ডেলার ৬ সন্তানের জনক।

কর্মজীবন




শুরুর দিকে  ম্যান্ডেলা একটি খনিতে প্রহরীর কাজ করেন। পড়াশোনা শেষ করে জোহানেসবার্গে অাইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের নেতৃত্ব

নেলসন ম্যান্ডেলার সংগ্রামী জীবন শুরু হয় মূলত ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। সেই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্র সংসদের ডাকা অান্দোলন অংশ নেন। তিনি বর্ণবাদ বিরোধী অান্দোলনের সাথে যুক্ত হন যখন ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়াটার্সরান্ডে অাইন বিষয়ে পড়াশোনা করছিলেন। তিনি অাফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ১৯৫২ সালের অসহযোগ অান্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও ১৯৫৫ সালে কংগ্রেস অব দ্য পিপলের সম্মেলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেই সম্মেলন ছিল দক্ষিণ অাফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী অান্দোলনের মূল ভিত্তি। নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৬১ সালে এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন উমখোস্ত উই সিযওয়ে (MK) এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

কারাবাস

বর্ণবৈষ্যমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার কারণে ১৯৬২ সালের ৫ অাগস্ট নেলসন ম্যান্ডেলাকে গ্রেপ্তার করে জোহানেসবার্গের দূর্গে বন্দী করা হয়। ফাঁসির পরিবর্তে তাকে ১৯৬৪ সালের ১২ জুন যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। ২৭ বছরের কারাদন্ডে প্রথম ১৮ বছর কাটান রবেন দ্বীপে। ১৯৮৫ সালে ম্যান্ডেলাকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি তা প্রত্যাখান করেন।

মুক্তি লাভ

দক্ষিণ অাফ্রিকার রাষ্ট্রপতি এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক ১৯৯০ সালে বর্ণবিরোধী সংগঠনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ঐ বছরের ১১ ফেব্রুয়ারিতে নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেয়া হয়।

প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট

নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সালে গণতান্ত্রিক উপায়ে দক্ষিণ অাফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সফল ভাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেন।

শান্তিতে নোবেল বিজয়

দক্ষিণ অাফ্রিকার সরকারের সাথে শান্তি অালোচনায় অবদান রাখার জন্য ১৯৯৩ সালে নেলসন ম্যান্ডেলাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। একই বছর রাষ্ট্রপতি এফ ডব্লিউ ক্লার্কও শান্তিতে নোবেল পান। এছাড়া ম্যান্ডেলা ২৫০টির অধিক পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম ভারত সরকার পদত্ত ১৯৯০ সালের ভারতরত্ন পুরস্কার ।

নেলসন ম্যান্ডেলার প্রকাশিত বই

নেলসন ম্যান্ডেলা বেশ কয়েকটি লিখেছেন। ‘কনভারসেশন উইথ মাইসেলফ’ তার লেখা অন্যতম একটি বই। এই বইটিতে স্থান পেয়েছে ম্যান্ডেলার বাছাইকৃত ব্যক্তিগত চিঠি, ডায়েরি। বইটি ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। ২০টি ভাষায় অনূদিত হয় বইটি। ২২টি দেশে বইটি প্রকাশ পায়। তার লেখা অন্য বইগুলো লং ওয়াক টু ফ্রিডম, দ্য স্ট্রাগ্রল ইজ মাই লাইফ, নো ইজি টু ওয়াক, এ প্রিজনার ইন দ্য গার্ডেন ইত্যাদি।

নেলসন ম্যান্ডেলার অনুপ্রেরণামূলক উক্তি

নেলসন ম্যান্ডেলা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতেন। বক্ত্যবে তিনি অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা বলতেন। সেসব বক্তব্যের প্রেরণাদায়ক কিছু উক্তি নিচে দেয়া হল।
  • পৃথিবীতে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে অাপনি যতটা অর্জন করতে পারবেন, তার চেয়ে ঢের বেশী অর্জন করতে পারবেন ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে।
  • যদি কেউ ঘৃণা করতে শেখে তাহলে সে ভালোবাসা শিখে নিতে পারে। ঘৃণা নয়, মানব হৃদয়ে স্বাভাবিক ভাবে ভালোবাসার জন্ম হয়।
  • অামার সফলতার ভিত্তিতে অামাকে বিচার করো না, অামাকে বিচার করো অামার ব্যর্থতা দিয়ে এবং ব্যর্থতার পর ঘুরে দাঁড়ানোর ভিত্তিতে।
  • পেছন থেকে নেতৃত্ব দাও- অার সাথে অন্যদের বিশ্বাস দাও যে নেতা সামনের সারিতে রয়েছে।
  • শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, যা দিয়ে তুমি পৃথিবী বদলে দিতে পরবে।
  • সম্মান তাদের প্রাপ্য, যারা কখনো সত্য কে পরিত্যাগ করে না, এমনকি যখন পরিস্থিতি অন্ধকারচ্ছন্ন এবং বেদনাদায়ক।
  • অামি বর্ণবাদকে ঘৃণা করি কারণ এটা একটা বর্বর বিষয়, তা সে কালো বা সাদা যে কোনো মানুষের কাছ থেকে অাসুক।
  • পতনের ভয় থাকার চেয়ে মিথ্যার মধ্যে থাকা বেশী গৌরবের মনে হয় কিন্তু উত্থানের সময় অামরা বারবার পড়ে যাই
  • যখন একজন মানুষ বিবেচনা করে যে নিজ জাতি এবং স্বদেশের প্রতি সে তার দায়িত্ব পালন করছে, তখন সে শান্তিতে মৃত্যু বরণ করতে পারে।

পরলোকগমন

নিপীড়িত মানুষের প্রিয় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তিনি অামাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার অাদর্শ পৃথিবীর মানুষ লালন করবে যুগ যুগ ধরে।

No comments

Powered by Blogger.