চাকরির সহায়ক সিভিতে লিঙ্কডইন
সিভি, কভার লেটার তৈরি শেষ? তো এবার তাহলে চলুন, লিঙ্কডইনে কিভাবে প্রোফাইল তৈরি করতে হয়, কিভাবে চাকরির আবেদন করতে হয় একটু জেনে নেই। প্রতিবারের মতো আজও একটি উদাহরণ দিয়েই লেখা শুরু করি। আমি মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু করি ২০০৪ সালে। প্রথম যখন ফোন কিনি তখন ভেবেছিলাম আমার তো ফ্যামিলি আর দুই চারজন বন্ধু ছাড়া আর কাউকে প্রয়োজন নেই। শুধু শুধু নম্বর কিভাবে সেভ করা না শিখে মুখস্থ করে ফেললেই হয়। এভাবে দিন যেতে থাকে, আমিও সবার নম্বর মুখস্থ করতে থাকি। এভাবে ৩০-৪০টি নম্বর মুখস্থ করলাম। তারপর বুঝলাম কাজটা আর সম্ভব নয়। আমাকে নম্বর সেভ করা শিখতে হবে এবং নম্বর সেভ করেই রাখতে হবে। গল্পটা বলার উদ্দেশ্য যুগের চাহিদা, উন্নয়নকে এড়িয়ে গিয়ে আপনি নিজে এগোতে পারবেন না। ২০১৬ সালে আপনি ইমেইলের পরিবর্তে চিঠি পাঠানোর চিন্তা করলে নিজেই বোকা বনে যাবেন।
লিঙ্কডইন কী?
আসুন, সন্ধি বিশ্লেষণ করি। লিঙ্কডইন = লিঙ্ক+ইন, ‘ইন’ মানে ভিতরে আর ‘লিঙ্ক’ মানে সংযুক্তি বা সংযোগ। তার মানে কি? যার ভিতরে গেলে লিঙ্ক আছে তাকেই লিঙ্কডইন বলে, নাকি? জী, একদম ঠিক, লিঙ্কডইন অনেকটা ওই রকমই। আপনি হয়তো বলবেন, আমার মামা, খালা, চাচারাই তো আমার লিঙ্ক। তাদেরকে বলছি, কাজকে নিজের সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরুন। ৪০০ মিলিয়ন মামা, খালা কাকুরা লিঙ্কডইনে আপনার অপেক্ষায় আছে।
লিঙ্কডইন অনেকটা ফেসবুকের মতোই। ফেসবুকে যেমন কোথায় খাচ্ছেন, ঘুরছেন এসব শেয়ার করা যায়, তেমনি লিঙ্কডইনে কোথায় কাজ করছেন, কি করছেন, নতুন কি করলেন সেগুলো দেয়া যায়, নোট পাবলিশ করা যায়। নিজেকে তুলে ধরুন লিঙ্কডইনের মাধ্যমে। মনে রাখবেন, নিজের ঢোল নিজেকেই পিটাতে হয়, অন্যকে ঢোল দিলে তা বাজাতে গিয়ে তারা ফাটিয়ে ফেলে।
লিঙ্কডইন কেন দরকার? কিভাবে এটি কাজ করে?
১। বর্তমানে প্রফেশনালদের সবচেয়ে বড় সামাজিক মাধ্যম হচ্ছে লিঙ্কডইন। পুরো দুনিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। আপনি কেন পিছিয়ে থাকবেন? ৪০০ মিলিয়ন মামা, খালা, চাচা এক জায়গায় আর কোথায় পাবেন?
২। লিঙ্কডইন একটি বৈশ্বিক যোগাযোগের মাধ্যম। দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তের যে কোনো কোম্পানির যে কোনো লোককে পাওয়া সম্ভব লিঙ্কডইন দ্বারা।
৩। উন্নত দেশগুলোতে লিঙ্কডইনের মাধ্যমে অনেকেই পাচ্ছে মনের মতো চাকরি।
৪। ওয়েবসাইটের সঙ্গে সংযুক্ত করার মাধ্যমে চাকরির সব বিজ্ঞপ্তি আপনি পাবেন লিঙ্কডইনে।
৫। লিঙ্কডইন আপনাকে বাছাই করে বলে দিবে আপনার আসলে কোন কোন চাকরির জন্য আবেদন করা দরকার।
৬। আপনার ভালো কাজের জন্য আপনাকে আপনার কলিগ বা বস রেকমেন্ড করতে পারে যা কিনা আপনাকে পরবর্তী চাকরি পেতে অনেক সাহায্য করবে।
৭। লিঙ্কডইনে আপনার যে কোনো পোস্ট কেউ লাইক, শেয়ার বা কমেন্ট করলে সেটা তার প্রোফাইলেও যারা যুক্ত আছে তাদের হোমপেজে চলে যাবে। অনেকের মধ্যে নিজের ভালো কাজের খবর ছড়িয়ে দিতে লিঙ্কডইনের জুড়ি নেই।
৮। লিঙ্কডইন ব্যবহার করে আপনি সরাসরি আবেদন করতে পারবেন অনেক বহুজাতিক কোম্পানিতে।
৯। দেশী ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পেজ বা গ্রুপ ফলো করলে পাবেন তাদের আপডেটগুলো।
১০। কোথাও আবেদন করার সময় ওই কোম্পানি কেমন, কারা ওই কোম্পানিতে চাকরি করছেন ইত্যাদি নানা তথ্য পাবেন লিঙ্কডইনে।
কিভাবে তৈরি করবেন আকর্ষণীয় লিঙ্কডইন?
ধরুন, আপনার সিভি লেখা শেষ, সিভিতে আপনার পার্সোনাল তথ্যগুলো যেভাবে বসিয়েছেন ঠিক একইভাবে লিঙ্কডইনেও বসান। প্রফেশনাল ছবি দিন। চলুন, স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে যাই-
১। সারাংশ : লিঙ্কডইন প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাইবে। নিজেকে কৃতকর্মের মাধ্যমে পরিচিত করান এবং কি কি কাজ জানেন বা কি করতে চান তুলে ধরুন। মিশন ও ভিসন স্টেটমেন্ট লিখুন। লিঙ্কডইন আপনকে দিচ্ছে আপনার যে কোনো ভিডিও ব্লগ, ডকুমেন্ট, প্রেজেন্টেশন আপলোড করার সুযোগ। নিজের সিভিটি এখানে আপলোড করে রাখতে পারেন।
২। এক্সপেরিয়েন্স : ঠিক যেমন তৈরি করেছেন সিভিতে। কপি পেস্ট করে বসিয়ে দিন, কনট্রোল সি ও কনট্রোল ভি এর মামলা। এক্ষেত্রেও লিঙ্কডইন আপনাকে ডকুমেন্ট, ইমেজ, ভিডিও, যুক্ত করার সুযোগ দিয়েছে। কোনো কোম্পানিরই গোপনীয় কোনো তথ্য দেয়া যাবে না। কিন্তু ধরুন, আপনি একটি ট্রেনিং করেছেন বা করিয়েছেন, আপনি প্রেজেন্টেশন দিয়েছেন, আপনার কোম্পানির কোনো পাবলিশ হওয়া লেখা, ভিডিও, কোনো ফিচার এখানে আপলোড করুন। সিভিতে এই সুযোগ নেই। একাধিক কোম্পানিতে চাকরির অভিজ্ঞতা থাকলে প্রতি ক্ষেত্রে একই পন্থা অবলম্বন করুন।
যারা ফ্রেশার তারা ইন্টার্নশিপ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিসিট, মেম্বারশিপের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার ঘরটি পূরণ করুন। কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজের মাধ্যমে আপনি কোন কোন কাজে অভিজ্ঞ ফুটিয়ে তুলুন। কোন কাজে সেচ্ছাসেবক হিসেবে ছিলেন বা কোন কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন অল্প কিছু দিনের জন্য। সেটাও বসানোর সুযোগ আছে লিঙ্কডইনে।
৩। এন্ডোর্সমেন্ট : ব্যাপারটা অনেকটা ভোটের মতো। আপনি এখানে আপনার ৫০টি স্কিলের নাম বলবেন। আপনার সবচেয়ে ভালো ১০টি স্কিল লিঙ্কডইন দেখাবে। আপনার সঙ্গে যারা কানেক্টেড হবেন তারাই বলে দেবেন যে আপনি যে দক্ষতাটি উল্লেখ করেছেন আসলে আপনি ওই ব্যাপারে কতটা দক্ষ। অবশ্যই লিঙ্কডইনে এন্ডোর্সমেন্ট বাড়াবেন যাতে অন্যরা আপনার প্রোফাইল দেখে আপনার দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা পায়। ধরুন, আমি ট্রেইনার। এখন আপনি যদি আমাকে এন্ডোর্স করেন ট্রেইনার হিসেবে, তাহলে অন্য কেউ যখন আমার প্রোফাইল দেখবেন, তখন উনি ধারণা পাবেন যে আমি ট্রেইনার। কারণ আপনি আমাকে ট্রেইনার হিসেবে সার্টিফাই বা এন্ডোর্স করেছেন।
৪। শিক্ষাগত যোগ্যতা : সিভি থেকে এক এক করে সবগুলো বসিয়ে নিন। সার্টিফিকেট চাইলে স্কান করে যুক্ত করে দিতে পারেন। প্রফেশনাল সার্টিফিকেট যুক্ত করা ভালো।
৫। প্রকাশনা : কারও কোনো লিখা, কোনো জার্নাল ছাপা হয়ে থাকলে লিঙ্কসহ সেটিও দিয়ে দিন। মজার বিষয় হচ্ছে, আপনি যখন প্রোফাইল সাজাবেন তখন লিঙ্কডইন নিজেই আপনাকে অনেক নির্দেশনা দিবে।
৬। ট্রেনিং : সিভি থেকে এক এক করে ট্রেনিংগুলো তুলে নিন। কোন কোর্স করা থাকলে সেটি অ্যাড করুন।
৭। টেস্ট স্কোর : জিআরই, আইইএলটিএস, টোফেল পরীক্ষার স্কোর দিতে পারেন। যুক্ত করতে পারেন সার্টিফিকেটও।
৮। পুরস্কার : আপনি হয়তো চাকরির পাশাপাশি কোন কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন। কোনো সমাজসেবামূলক কাজ, কোনো খেলাধুলা, স্কাউট, বিতর্ক ইত্যাদি, সেগুলো উল্লেখ করতে পারেন। চাকরিতে পাওয়া পুরস্কারের কথা এক্সপেরিয়েন্স অংশে লেখাই ভালো।
৯। প্রোজেক্ট : আপনি হয়তো কোনো প্রোডাক্ট লঞ্চ করেছেন, কোনো নতুন মেশিন বসিয়েছেন কোম্পানিতে, কোনো ইভেন্ট অ্যারেঞ্জ করেছেন। এগুলোর প্রত্যেকটিই প্রজেক্ট। এগুলো সাবলীল ভাবে উল্লেখ করুন। মনে রাখবেন, নিত্যদিনের কাজগুলো কিন্তু প্রজেক্ট না। প্রজেক্টের শুরু আছে, শেষ আছে। প্রজেক্ট ইউনিক।
১০। সার্টিফিকেশান : ধরুন আপনি কোনো ক্লাবের মেম্বার, কোনো দলের সভাপতি। সেই সার্টিফিকেটগুলো এখানে তুলে ধরতে পারেন।
১১। প্যাটেন্ট : আপনার কোনো নতুন আইডিয়া যা কিনা আপনার নিজের বা কোম্পানির জন্য বিরাট সাফল্য বয়ে এনেছিল, এখানে সেগুলো উল্লেখ করুন। আপনি হয়তো কোম্পানিতে কোনো একটা পলিসি তৈরি করে দিয়ে এসেছেন, যেটা আগে ছিল না।
কেউ রেফারেন্স হিসেবে চাইলে 'Niaz Ahmed' লিখে আমার লিঙ্কডইন প্রোফাইল দেখতে পারেন। যদিও আমি বলব না যে আমারটিই সেরা। সিভি তৈরি ছাড়া লিঙ্কডইন তৈরি অসম্ভব। প্রথমে সিভি তৈরি করুন, তারপর লিঙ্কডইন, তারপর জব পোর্টালে সিভি আপলোড দিন। লিঙ্কডইন প্রোফাইল পাবলিক করে রাখুন। কাজ করেছেন, সেটা লোকে জানুক, ক্ষতি নেই তো। চাকরি দাও, চাকরি দাও। নিজে নিজে চিৎকার না করে নিজের কাজগুলোকে আকর্ষণীয়ভাবে ফুটিয়ে তুলুন। আপনার কাজই আপনার হয়ে সুপারিশ করবে। সময়ের অগ্রযাত্রা ও যুগের চাহিদাকে চ্যালেঞ্জ করবেন না, ফেসে যাবেন। সবাইকে ধন্যবাদ ধৈর্য সহকারে লেখাটা পড়ার জন্য।
লেখক : (ট্রেইনার ও প্রফেশনাল সিভি রাইটার) চিফ নলেজ ডিস্ট্রিবিউটর, কর্পোরেট আস্ক
ই-মেইল : niazabeed@gmail.com
No comments