ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে
গত চার পর্বের লেখায় জানিয়েছি কীভাবে সিভি তৈরি করবেন, কভার লেটার তৈরি করবেন, লিঙ্কডইন তৈরি করবেন, আবেদন পত্র জমা দেবেন, কত ভাবে ইন্টারভিউ হতে পারে এবং কিছু কমন ইন্টারভিউ টিপস। এবারে আপনাদের জানাব কীভাবে ইন্টারভিউ প্রশ্নের উত্তর করবেন। অনেক লিখাই আছে এই সম্পর্কে। আমরা অনেকে হয়তো পড়েছি। কিন্তু তাও সমস্যা রয়েই গেছে। আমি খুব বিস্তারিতভাবে আপনাদের জানাব কীভাবে ইন্টারভিউ বোর্ড ফেস করতে হবে। মূল লেখায় যাওয়ার আগে দুটি বিষয় না বললেই নয় :
১। আমরা যেটা ভুল করি তা হল, আমরা নিজেরাই জানি না আমরা আসলে জীবনে কি হতে চাই। তাই ইঞ্জিনিয়াররা করছে ব্যাংক জব, এইচ আরে পড়ে কাজ করছেন হাসপাতালে। এরকম যারা আছেন, তাদের বলি। আগে নিজে ভাবুন কি হতে চান জীবনে। আপনার কোন কাজ ভালো লাগে। না জেনে না বুঝে আবেদন করবেন না। হয়তো জীবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু আজ থেকে সব ঠিক করে সামনে এগিয়ে চলা সম্ভব।
২। যারা ফ্রেশার অথবা যারা এখনও পড়াশোনা করছেন তাদের বলি, বছরে ৫২ টি সপ্তাহ। ২ দিন করে ছুটি পেলে বছরে ছুটি ১০৪ দিন। ঈদ, পূজা, গ্রীষ্ম ও শীতকালীন ছুটি বাদেই ১০৪ দিন পাক্কা ছুটি। চার বছর পড়াশোনায় ১০৪ঢ৪ অর্থাৎ ৪১৬ দিন ছুটি পাওয়া যায়। তার মানে চার বছরে এক বছরই ছুটি। ছুটিগুলো কাজে লাগান প্লিজ। কম্পিউটারে গেম খেলে, বাসায় গিয়ে অলস সময় না কাটিয়ে পার্ট টাইম কাজ নিন। আউট সোর্সিং শিখুন, এক্সেল শিখুন, পাওয়ার পয়েন্ট শিখুন, ইংরেজি শিখুন। কোনো কোম্পানির হয়ে কাজ করুন। বাইরের সব ছাত্র-ছাত্রীর ছাত্রজীবনেই অনেক কাজের অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। আমরাই পুতুলের মতো বসে থাকি। পাস করা পর্যন্ত সবাই বেকার। সবাই ভাবি পাস করলে কোম্পানিগুলো বাড়িতে পালকি নিয়ে এসে চাকরি দিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। দয়া করে এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসুন। নয়তো প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
দুনিয়ার যেখানেই আপনি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যান না কেন, প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হবে। প্রথম প্রশ্ন, ‘আপনার সম্পর্কে বলুন’
আমরা সাধারণত এ রকম ক্ষেত্রে কি করি? একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। দেখুন তো, মিলে যায় কিনা। ‘উমমমম ... আমার নাম শরীফ হাসান। এএএ ... আমার পিতার নাম রহমত মিয়া। আমরা পাঁচ ভাই। আমি শহীদ নুর ইসলাম স্কুল থেকে ক্লাস ২০০৫ সালে এসএসসি পাস করি ...উউউ... আমি বিয়ে করেছি। আমার ঘরে দুই ছেলে।’ কি ভাই? আপনিও কি ইন্টারভিউয়ের সময় এভাবেই প্রশ্নের উত্তর করেন নাকি?
মনে রাখবেন এটা কিন্তু এক রকম ফাঁস হওয়া প্রশ্ন। তাই, আপনার উত্তর হতে হবে সুস্পষ্ট এবং সাবলীল। ঋত্বিক রোশানের ‘ধুম-২’ সবার দেখা আছে নিশ্চয়ই। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে আপনি কিন্তু ঋত্বিক। যে পোস্টে আবেদন করেছেন কথা বলতে হবে ওই পোস্ট মাথায় রেখে। আপনি মানুষ একজন কিন্তু রূপ হবে অনেক রকম।
এবার মূল লেখায় আসি। ধরুন, আপনি কোনো একটি কোম্পানিতে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার জন্য আবেদন করেছেন। আপনাকে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে কাজের মাধ্যমে। যাদের এক্সপেরিয়েন্স একদমই নেই, তাদের কথা বলতে হবে কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজ অনুযায়ী। চলুন, দেখে নেয়া যাক, আপনি কীভাবে উত্তরটি দেবেন।
বিক্রয় পেশার জন্য নিজেকে পরিচিত করাবেন যেভাবে : আপনার উত্তর হতে পারে এরকম ‘স্যার আমি আপেল মাহমুদ, আমি ছাত্রাবস্থায় আমার ইউনিভার্সিটিতে ‘কর্পোরেট আস্ক’ নামক একটি কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলাম। এটি একটি ট্রেনিং ফার্ম। ট্রেনিং করার মাধ্যমে কীভাবে ছাত্রাবস্থায়ই কর্মজীবনের জন্য অগ্রসর হওয়া যায় সেই বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতাম। আমার ভার্সিটিতেই আমি ‘কর্পোরেট আস্ক’-এ প্রায় ১০০ ক্লায়েন্ট এনে দিয়েছি মাত্র ৩ মাসে। ভার্সিটির টুরিস্ট ক্লাবের আমি ছিলাম সক্রিয় সদস্য। আমার ৩৫টি জেলা ঘোরা আছে। আমি মানুষের সঙ্গে মিশতে, তাদের জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে খুব পছন্দ করি। ক্লাবের সদস্য হিসেবে আমি প্রতি বছর শীতার্তদের জন্য কম্বল সংগ্রহের কাজ করি ও সেই কম্বল বিতরণ করি। আমি খেলাধুলায় খুব ভালো। কলেজে থাকতে আমাদের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলাম আমি।’
(মনে রাখবেন, কেউ হয়তো বিতর্কে ভালো, কেউ ইভেন্ট করেছেন, কেউ হয়তো ক্লাব করেন, কেউ হয়তো সোশ্যাল কাজ করছেন, যে ব্যক্তি যে কাজ করেছেন, তিনি ওই অনুযায়ী কথা বলবেন, কথা হবে, কাজের মাধ্যমে, আমতা আমতা করার কোনো সুযোগ নেই)
এ রকমভাবে উত্তর কেন করবেন?
দেখুন, আপনি ফ্রেশার। এক্সপেরিয়েন্স কালেক্ট করাই আপনার বড় চ্যালেঞ্জ। চাকরির ক্ষেত্রে একজন রিক্রুইটার বেছে নিতে চায় একজন সেরা কর্মী। যেহেতু আপনি সেলসের জন্য আবেদন করেছেন সেহেতু আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি ভবিষ্যতেও ভালো সেলস করতে পারবেন। আপনিই বেস্ট ক্যান্ডিডেট। খেয়াল করুন, লাইন বাই লাইন ধরিয়ে দিচ্ছি আপনাদের। আপনি ‘কর্পোরেট আস্ক’-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলেন। তার মানে আপনি প্রোডাক্ট প্রমোশনের কাজ আগে থেকেই জানেন। আপনি লোকজনের সঙ্গে মিশতে পারেন কারণ ওই কোম্পানির হয়ে আপনি প্রচার কাজ করতেন। আপনি ১০০ ক্লায়েন্ট এনেছেন, তার মানে আপনি টার্গেট পূরণ করতে পারেন। আপনি ৩৫টি জেলা ঘুরেছেন। সেলস পেশায় ট্রাভেলিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজ। আপনি খেলাধুলায় ভালো, মানে আপনি পরিশ্রমী। আপনি ক্যাপ্টেন ছিলেন। আপনি কম্বল বিতরণ করেন, মানে আপনি মিশুক, সামাজিক, উদার, বিনয়ী। আপনি নেতৃত্ব দিয়ে ছোটখাটো দল পরিচালনার ক্ষমতা রাখেন। খেয়াল করে দেখুন তো, একটি কথাও অবান্তর কিনা। মনে রাখবেন, রিক্রুইটার কাজের লোক খুঁজছে, পিতা-মাতার নাম কিংবা সার্টিফাইড বিবাহিত লোক কিন্তু কোম্পানি খুঁজছে না। তাই, এসব বলা অবান্তর।
মানবসম্পদ বিভাগের জন্য যেভাবে কথা বলবেন : সব সময় একই পদের জন্য আবেদন না-ও করতে পারেন। ধরুন, আপনি একই ব্যক্তি এখন অন্য একটি কোম্পানিতে মানবসম্পদ বিভাগের জন্য আবেদন করেছেন। এক্ষেত্রে কীভাবে উত্তর দেবেন, ‘স্যার আমি আপেল মাহমুদ, আমি ছাত্রাবস্থায় আমার ইউনিভার্সিটিতে ‘কর্পোরেট আস্ক’ কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলাম এবং ওদের কাস্টমার হ্যান্ডেল করতাম। ওদের ১০০ কাস্টমারের সঙ্গে আমাকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হতো। আমি ভার্সিটির টুরিস্ট ক্লাবের সদস্য ছিলাম। দল গোছানো ও নিয়মমাফিকভাবে ক্লাবের কার্যক্রম পরিচালনা করতাম। ক্লাব থেকে আমরা ভার্সিটিতে একবার ফায়ার ফাইটিংয়ের ওপর ট্রেনিং করিয়েছিলাম। আমি দেশের ৩৫টি জেলায় ঘুরেছি, ভিন্ন ভিন্ন আচরণের মানুষ ও তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে, মানিয়ে নিয়ে চলা আমার খুবই পছন্দের। আমি কলেজে থাকতে যখন ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলাম, তখন হঠাৎ একদিন আমার দুই টিম মেম্বার বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে মিটমাট করিয়ে দেই। আমি তাদের বলেছিলাম একজন আরেকজন সম্পর্কে আক্রমণাত্মক কথা না বলে আগের ভালো কিছু নিয়ে ভেবে একজন আরেকজন সম্পর্কে একটি ভালো কথা বলতে। তারা একজন আরেকজনের ভালো দিক যখন বলতে লাগলো, তখনই আসলে বোঝা গেল তারা কত ভালো বন্ধু ছিল। আমি মানুষের আচার-আচরণের বিচিত্রতা খুব পছন্দ করি ও মানুষের সঙ্গেই মিলেমিশে কাজ করতে চাই কোনো বড় লক্ষ্যকে সামনে রেখে।’
পরিবর্তনটা লক্ষ্য করুন : খেয়াল করে দেখুন, একই লোক, একই তার জীবন, কিন্তু কথাবার্তাগুলো কেমন চেঞ্জ। বিক্রয় থেকে সোজা পিপল ম্যানেজমেন্ট। এখন এই লোকটিই যখন প্রডাকশনের জন্য ইন্টারভিউ দেবে তখনও তাকে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে ভিন্ন আঙ্গিকে। আপনি কোন পেশায় যাবেন সেটা নির্ভর করে আপনার পড়াশোনা, রেজাল্ট, কো-কারিকুলাম আক্টিভিটিজের ওপরে। প্রথম চাকরি মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবুঝের মতো ‘আমাকে যে কোনো কাজ দিন, আমি যে কোনো কাজ করব’, এ রকম বলবেন না। ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। আপনার কি ভালো লাগে? কীভাবে আপনি জীবন গড়তে চান? কোন কাজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ছাত্রজীবন থেকে নিজেকে ওইভাবে গড়ুন। নিজেকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরুন। আপনি তৈরি হয়েই এসেছেন। চাকরির মুকুট আপনারই হবে। নিজেকে কখনোই দুর্ভাগা ভাববেন না। ‘সুপারিশ ছাড়া চাকরি হয় না’ এই ধারণা মাথা থেকে ফেলে দিন। মনে রাখবেন, হীরা যেখানেই ফেলে রাখা হোক না কেন, সে তার উজ্জ্বলতা ছড়াবেই। আপনিও আজ থেকে নিজেকে গড়ে তুলুন সেই উজ্জ্বল হীরা হিসেবে।
চাকরিজীবীরা যেভাবে উত্তর দেবেন : যারা চাকরি করছেন তারাও একইভাবে নাম বলে সরাসরি চলে যাবেন কাজের কথায়। আপনাকে কথা বলতে হবে স্মার্টলি এবং SMART ভাবে। SMART দ্বারা বোঝাচ্ছে S=Specific (সুনির্দিষ্ট) M=Measurable (পরিমাপযোগ্য) A=Achievable (সাধনযোগ্য) R=Realistic (বাস্তব) T=Time Bounded (নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে)। একটি উদাহরণ দেই-
ধরুন, ‘আমি ভাত খাই’, এই কথা থেকে আপনি কি বুঝবেন? তেমন কিছুই না।
কিন্তু যদি বলি, ‘আমি তিন বেলা ভাত খাই।’, আপনি আগের বারের চেয়ে একটু ভালোভাবে বুঝলেন আমার কাজ সম্পর্কে। আমি বললাম, ‘আমি সকালে, দুপুরে ও রাতে ভাত খাই’ নিশ্চয়ই এবার আপনি আরও ক্লিয়ার। যদি আমি বলি, ‘আমি সকাল ৮টা, দুপুর ২টা ও রাত ৯টায় ভাত খাই’, আপনার কিন্তু আমার কাজ সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ, দ্বিধা কিংবা জিজ্ঞাসা থাকবে না। দেখুন শেষের বিবৃতিটি কত নির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য, সাধনযোগ্য, বাস্তব ও সময়রেখার মধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে। যারা চাকরি করেন, তারা কখনও গৎবাঁধা কথা বলবেন না। আমি মেশিন দেখাশোনা করি, আমি রিপোর্ট করি, আমি কাস্টমার ভিজিট করি, এভাবে কথা বলবেন না। কতগুলো মেশিন আপনার দেখতে হয়, কতগুলো রিপোর্ট করেন, কি কি রিপোর্ট করেন, কতগুলো কাস্টমার ভিজিট করেন সেগুলোসহ নিজেকে তুলে ধরেন। সিভিতে সেই তথ্যগুলো দিয়ে দিন যাতে চাকরিদাতা বোঝে যে আপনি কত বড় বনের বাঘ। কোথায় কোন প্রজেক্ট করেছেন, কোন কাজ করেছেন, কোথায় লিড দিয়েছেন কোন টিম, কি করেছেন সব কথা এসবের মধ্যেই বলতে হবে। আপনার পরিচয় হবে কেবলই কাজ করার মনোভাব। সর্বোপরি সর্বদা আত্মবিশ্বাসী হন।
সবাইকে লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
লেখক : ট্রেইনার ও প্রফেশনাল সিভি রাইটার,
চিফ নলেজ ডিস্ট্রিবিউটর, কর্পোরেট আস্ক
ই-মেইল : niazabeed@gmail.com
No comments