পার্টটাইম চাকরি সম্পর্কে ভুল ধারণা হচ্ছে না তো?




চাকরী জীবন্ত হরিণ নয় যে তাকে ছুটে ছুটে ধরতে হবে, চাকরী সোনার হরিণ। একটি সামান্য জড় পদার্থ যা তার জায়গায় সদাই স্থির। চলতে ফিরতে পারে না। কাজেই আপনি যদি যোগ্য হন সেই সোনার হরিণ পাওয়ার, তাহলে তা অন্যে নিয়ে যাবে সেই সাধ্য কি কারো আছে? এখন প্রশ্ন হচ্ছে যোগ্যতা বোঝা যাবে কিসে? যোগ্যতা বুঝানোর অন্যতম সহজ উপায় হচ্ছে পার্ট টাইম জব।

ফ্রেশারদের ক্ষেত্রেও মানব সম্পদ বিভাগের লোকেদের কমন জিজ্ঞাসা থাকে, “আপনার কোন অভিজ্ঞতা আছে? এ ধরনের কাজ আগে করেছেন?” তারা আসলে জানতে চায়, আপনার কোন কো-কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিজ, পার্ট টাইম চাকরী এসব অভিজ্ঞতা আছে কি না। আমি আপনাকে পারচেজ ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব দিবো, এখন আপনি যদি কোনদিন বাজার সদাই, কেনা-কাটা না-ই করেন, আমি কিভাবে ভরসা পাবো আপনার উপর? আপনি হলে কি সেটা পেতেন? মনে রাখবেন, ইন্টারভিউর সময় ফ্রেশারদের চাকরীর অভিজ্ঞতা জিজ্ঞেস করা হয় না, একই রকমের কাজ আগে করেছেন কি না সেটা জিজ্ঞেস করা হয়। “আমি তো ফ্রেশার, কাজের অভিজ্ঞতা পাবো কোথায়?” এই বাণী এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। কোম্পানি আপনাকে চাকরী দিতে দায়বদ্ধ নয়।
বিদেশে অনেকে পি এইচ ডি করছে এমন ছাত্র-ছাত্রী রেস্টুরেন্ট বা সুপার শপে কাজ করে, পড়াশুনার সাথে সাথে নিজের খরচটা যাতে হয়ে যায়, সেই আক্কেল বিদেশীদের মাঝে স্কুল জীবনেই হয়ে যায়। এসবের মধ্যেই তাদের লেখাপড়া চলে এবং এতে লেখাপড়াও কোন বিঘ্ন ঘটে না।
আমাদের দেশে পড়াশুনার পাশাপাশি বাড়তি কিছু করা বাবা-মা দের কাছে গুনার সামিল। থাইল্যান্ডে, মালয়শিয়াতে পেয়েছি রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করছে বাচ্চারা। আর আমাদের এখানে “বাচ্চারা, মোজা নোংরা করতো”, এই শিক্ষা নিয়ে কাটে ছেলেবেলা। অ্যাডগুলো আমাদের স্বভাবের আদলেই তৈরি। বাচ্চাদের শিখানো হয় পরনির্ভরশীলতা, আলসেমি। “চলো, আমরা নিজেরাই নিজেদের মোজা পরিষ্কার করি” টাইপের অ্যাডও তো করা যেত, তাই না?

কি ধরনের পার্ট টাইম চাকরী করা উচিৎ? সামান্য টিউশনি করানোর ক্ষেত্রেও বাঁধা পরিবার থেকে। যারা এতো কিছুর পরেও কিছু একটা করে তাদের আবার এমন কমেন্ট শুনতে হয়, “টাকার প্রতি লোভ এসে যাবে, মন বসবে না পড়ার টেবিলে।” মা হয়তো বলে বসবে, “কি? আমার ছেলে কাজ করবে?”  তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় বলা বাহুল্য, তা হচ্ছে, টিউশানি আপনাকে কোন স্বীকৃতি দেয় না। এটা কিছু টাকা দেয় মাত্র। কিন্তু যে কোন কোম্পানিতে পার্ট টাইম চাকরী আপনাকে স্বীকৃতি ও সম্মান দেয়। ধরুন, একজন শেষ বর্ষের ছাত্র ৬টি টিউশানি করাচ্ছে। তার মাসিক আয় ৩০,০০০টাকা। কিন্তু চাকরীর বাজারে কিন্তু অভিজ্ঞতা শূন্য। উপরন্তু তিনি যদি পাস করার পর ১৫,০০০ টাকা বেতনের চাকরীতে জয়েন করেন তাহলে তার জন্যে সেখানে টিকে থাকা খুব কঠিন হবে। উচিৎ হবে কোন কোম্পানির ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করা, কোন শপিং মলে কাজ করা, সেলসে পার্ট টাইম কাজ করা, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে কাজ করা, হিসাব-নিকাশ রাখার কাজ করা, শিক্ষকদের সাথে সহযোগিতামূলক কাজ করা, সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে এমন কাজ করা। মেয়েরা বিভিন্ন কুটির শিল্পের কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারেন। এই ধরনের কাজের সাথে সম্পৃক্ত হলে তা যে আপনাকে পরবর্তীতে কি পরিমাণ সামনের দিকে নিয়ে যাবে ভাবতেও পারবেন না। তাছাড়া এই সব কাজ আপনার সিভিকে করবে অনন্য, আপনাকে চাকরীর ইন্টারভিউ এর সময় করে তুলবে আরো আত্মবিশ্বাসী।
আমরা মুখে অনেকে বলছি পার্ট টাইম জব ভালো, কিন্তু আমরা কি সেটা মেনে নিচ্ছি? আমরা ছেলে মেয়েদের ল্যাপটপ দিচ্ছি, তারা গেম খেলে সময় নষ্ট করছে। নিজের থেকে তাদের কোন তাগিদ নেই কাজ করার, আর বাবা-মায়েরাও ছেলে মেয়ের পড়াশুনা করাকালীন কিছু করতে দিবে না। আমাদের দেশের কোন স্কুলের শিক্ষক যদি স্কুলের বাগানও ছাত্রদের দিয়ে পরিষ্কার করায়, তাহলে সেই শিক্ষকের চাকরীর ওইটিই হবে শেষ দিন। আর রাস্তা পরিষ্কার করাতে গেলে মনে হয় শিক্ষককে দেশ ছাড়তে হবে।
কিন্তু সমস্যাটা কোথায়? আপনি ভার্সিটিতে পড়ার পাশাপাশি আগোরাতে বা কোন রেস্টুরেন্টে ৪ ঘন্টা কাজ করেন, আপনার পরিবার জানলে যে কি হবে তা আল্লাহ মালুম। সামান্য সাপোর্ট এদেশের ছেলে মেয়েদের দেয়া হয়না বাড়তি কিছু করার জন্য। নিজের লক্ষ্য নির্ধারণের জন্যে। এখনো দেশে ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া সম্মানজনক কোন কাজ নেই যা পিতা-মাতা কর্তৃক স্বীকৃত। অনেকের হয়তো বিয়েই হয়নি, কিন্তু বিয়ের পর বাচ্চা হলে, সেই বাচ্চাকে ডাক্তার বানাবেন এটাও ঠিক করে ফেলেছেন।  সস্তা সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে অনেক মা-বাবাই সন্তানের ভবিষ্যত না বুঝেই ধংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। “তোমার বাবা কষ্ট করে ইনকাম করে, একদিন তুমিও করবে।”, এই ধরনের কথা দিয়ে একটা মানসিক চাপ তৈরি করা। তার চেয়ে বরং নিজেদের চিন্তা-ভাবনা এমন ভাবে গড়ে তুলুন যাতে আপনার ছেলে-মেয়ে কলেজ থেকে নিজের উপার্জন নিজে করতে পারে।
পূর্বের একটি লিখায় বলেছিলাম আমরা ৫২ সপ্তাহের একটি বছরে ১০৪ দিন ছুটি পাই। তাও আবার ঈদ, পূজা, গ্রীষ্মকালীন, শীতকালীন ছুটি বাদে। সেই হিসেবে ৪ বছরে ৪১৬ দিনই ছুটি। আমরা কি করছি? ঘরে বসে আছি? গেম খেলছি? আজকের এই আলসেমি আমাদের জন্য কি ভয়াবহ বার্তা বয়ে আনবে আমরা কি কেউ সেটা ভেবে দেখেছি?
আজকে যে শ্রম দিবো, কাল তার মূল্য পাবো।
সেদিন ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলাম যে ১০০ বার সিভি পাঠালে আপনারা কতবার কল পান? ১০০ টি কমেন্ট বিবেচনা করলে দেখতে পাই, ৬০ জন বলেছেন ২-৩টি, ৩০ জন বলেছেন ৪-৫টি, বাকি ১০জন ৮-১০টি করে কল পান। তার মানে গড়ে ১০০ বার সিভি পাঠালে আমরা ৪-৫ বার করে কল পাই। তাই একবার কল পেলে আমরা অনেকেই দিশেহারা হয়ে যাই। অনেকে আছেন তিন থেকে চার মাস পর পর ইন্টারভিউ কল পাচ্ছেন। আবার এক একটি আসনের বিপরীতে আপনাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে প্রায় ৩০-৪০ জনের সাথে। এখন সোনার সেই হরিণ তো সে-ই পাবে যে দাম দিয়ে তা কিনতে পারবে, তাই না?
আপনার কি আছে সেরকম অভিজ্ঞতা? আপনাকে কি সোনার হরিণের দায়িত্ব দেয়া যায়? ভাবুনতো একবার। আপনি গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন ২৫ বছর বয়সে। এই ২৫ বছরে কি আপনার অভিজ্ঞতা হয়নি? যে কোন ইভেন্ট অ্যারেঞ্জের দায়িত্ব নিন, পিকনিকের দায়িত্ব নিন। যে কোন টিম লিড করুন। সমিতি বা গ্রুপে যোগ দিন। ফেসবুক, লিঙ্কডইনে কোম্পানি পেজ গুলো ফলো করুন। ছাত্রাবস্থায় নেটওয়ার্কিং গড়ে তুলুন, ৫৫% সময় পড়াশুনা করুন, ৪৫% সময় নেটওয়ার্ক তৈরি করুন। কাজ করুন, ক্লাবের সাথে জড়িত হন। এই পার্ট টাইম চাকরী আপনার পাস করার পর আপনাকে দিবে অভিজ্ঞতা। আপনি অফিস কালচার, নিয়ম-কানুন, পলিসি, মিলে মিশে কাজ করা এসব নানান অভিজ্ঞতা পেয়ে যাবেন ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায়।

অপরদিকে পাশ করে বেরোনোর পর বেকারদের উপর থাকে লোক দেখানো পারিবারিক চাপ। “পাশের বাড়ির ভাবির ছেলের চাকরী হয়, তোমার কেন হয়না?” উঠতে বসতে খোঁটা, কিন্তু তরুন ছেলেটিতো মনে মনে চেয়েছিল ফটোগ্রাফার হতে। ইঞ্জিনিয়ার তো সে হতে চায়নি, তার তো মন টিকছে না। কে বুঝবে তার মনের কথা?
অন্যের স্বপ্নে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করা এই সকল হতাশ ছেলে মেয়েরা চূড়ান্ত ধরাটা খায় পাস করার পর। চাকরীর বাজারে হাহাকার। সকলেই এক্সপেরিয়েন্স চাচ্ছে, এক্সপেরিয়েন্স পাবো কোথায়? ভার্সিটিতে কাটানো সময়ে সেই ক্যান্ডি ক্রাশ অথবা ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান তখন আমাদের কথা আর শোনে না। কথায় বলে সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।
আমি জানি অনেকের জীবনই ভুল সিদ্ধান্তে ভরা। কিন্তু ভুলটা বুঝতে পারলে তা আর ভুল থাকে না, তখন তৈরি হয় নিজেকে শোধরানোর সুযোগ। জীবনে যাই হয়েছে, ভুলে যান। আজ থেকে নতুন করে শুরু করুন।

এর জন্যে কেউ না, আমরাই দায়ী। উপরে তাকিয়ে থুতু মারলে মুখে এসেই লাগবে। যে নিজেই নিজেকে দাবিয়ে রাখে, জগত তাকে জাগাতে পারে না। আত্মবিশ্বাসী হন নিজের ব্যাপারে, আত্মবিনাশী নয়। প্রত্যেক বিনোদনের একটি সমান ও বিপরীত ক্রন্দন থাকে। সকল কাজই কাজ, বড় ছোট বলে কিছু নেই। আজকে যে শ্রম দিবো, কাল তার মূল্য পাবো। গ্যারান্টি, বিফলে মূল্য ফেরত।
সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। ধন্যবাদ
নিয়াজ আহমেদ
ইমেইল: niazabeed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.